জাদু জগতের আষাঢ়ে গল্প-A real true story in magic.

magician P C Sorcar

জাদু জগতের আষাঢ়ে গল্প-A real true story in magic.

রাজীব বসাক

জাদু জগতের আষাঢ়ে গল্প: হল ভর্তি উপচে পড়া দর্শক তো ক্ষেপে আগুন। ঘড়ির কাঁটা ৮টা ছুঁই ছুঁই করছে, অথচ এখনও পর্যন্ত পর্দা উঠার কোন নামগন্ধ নেই। এরিমধ্যে ঘোষিত সময়ের চেয়ে এক ঘন্টা বেশি পেরিয়ে গেছে। আজ যিনি জাদু দেখাবেন, তার খ্যাতি বিশ্বজোড়া। অদ্ভুদ সব জাদু দেখিয়ে দর্শকদের তিনি অনায়াসেই মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখতে পারেন। তিনিই আজ ঘোষণা দিয়েছেন – নতুন কিছু যুগান্তকারী জাদু দেখানোর, যার তুলনা মেলা ভার। স্বভাবতই মিলনায়তনের ভেতরে আর তিল ধারনের জায়গা পর্যন্ত নেই। প্রবেশপত্র সংগ্রহ করতে না পেরে অনেকেই হা-পিত্তেশ করে ফিরে গেছেন।

অবস্থাটা যখন বেগতিকের দোড়গোড়ায়, ঠিক তখনি অনুষ্ঠান শুরুর ঘণ্টা পড়লো। পর্দার একটি অংশ উপরে উঠে গেল, বাদবাকী অংশ দু’পাশে সরে গেল। জ্বলের উঠল স্পট লাইট। তার নীচে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে রয়েছেন জাদুকর। আশ্চর্য তার বেহায়াপনা। বিজ্ঞাপিত সময়ের প্রায় ঘন্টাখানেক পর হাজির হয়েছেন, এতে লজ্জিত হওয়া তো দুরের কথা, উপরন্তু দর্শকদের সহাস্যে অভিবাদন জানিয়ে আমন্ত্রণ জানালেন তার জাদু প্রদর্শনী উপভোগের জন্যে।

বিক্ষুদ্ধ একজন দর্শক দাবী তুললেন তিনি যে এতগুলো লোককে ঘন্টাখানেক অযথা বসিয়ে রেখেছেন তার কৈফিয়ত চেয়ে।
জাদুকর তাতে বিন্দুমাত্র ভরকে না গিয়ে তার নিজের হাতঘড়িটির দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে বললেন, “মাফ করবেন, আপনারা বোধ হয় একটু ভুল করছেন। দয়া করে যার যার হাতঘড়ির দিকে একবার করে তাকাবেন কি?”

যার যার হাতে ঘড়ি ছিল, অনেকেরই ছিল, তারা তাকালেন। সাথে সাথে সম্পূর্ণ মিলনায়তন জুড়ে বিস্ময় আর শিহরণের একটি বিপুল ¯স্রোত বয়ে গেল। প্রত্যেকেরই ঘড়িতেই তখন সাতটা।

এ পর্যন্ত যারা সেই জাদুকরের উপর অন্যায়ভাবে ক্ষেপে গিয়েছিলেন, সে মুহূর্তেই তারা তার অদ্ভুদ জাদু দেখে নিমিষেই চুপসে গেলেন। জাদুকর হাসিমাখা মুখ নিয়ে দর্শকদের বললেন “এটাই আমার প্রথম জাদু।”

জাদু নিয়ে কোন গল্প জমে উঠলে কোন না কোনভাবে এই গল্পটিই একটু এদিক-ওদিক হয়ে কানে উঠবেই, এ প্রায় নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। আমি নিজেও এই একই গল্প কতবার যে কতমুখে শুনেছি, তার হিসেব কষতে বসলে মাইল পার হওয়া হাজার খানেক কলমের প্রয়োজন হবে। গল্পের মূল অবকাঠামো কিন্তু প্রতিবার, প্রতিক্ষেত্রেই প্রায় একই থাকে, শুধুমাত্র একটু-আধটু পাল্টেযায় তার বাহ্যিক পঠনশৈলী। যে যার খেয়ালখুশী এবং সাধ্যমত তার উপর রঙ ছড়িয়ে দেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বক্তাকে চেপে ধরলে দেখা যায় জাদুটি তিনি ঠিক নিজে দেখেননি, দেখেছিলেন তার নানা, চাচা, ফুপা কিংবা এমনি অপর কেউ, যাকে বলা যায় নির্ভরযোগ্য মিডিয়া। দু’একজন অবশ্য বেশ জোরের সাথেই বলেন যে এটি তার নিজের চোখে দেখা।

যাকে নিয়ে এই গল্প, তিনি আর কেউ নন, আমাদের দেশেরই টাঙ্গাইলে জন্ম নেয়া সর্বকালের সেরা জাদুকরদের একজন পি.সি.সরকার।

কলেজে ছাত্র থাকাকালে সেই ১৯৮৬ সাল থেকে জাদুর সাথে আমার পরিচয় এবং সেই সূত্রে জাদুর সাথে আমার হ্রদ্যতা। দেশে এবং বিদেশে অনেক অনেকগুলো জাদুকরের জাদু প্রদর্শনী আমি দেখেছি। কিন্তু আমার দুর্ভাগ্য যে, এই জাদুটি দেখার সুযোগ আমার এখনো পর্যন্ত হয়নি। সত্যি-সত্যিই কারো কখনো হয়েছে কিংবা হবে কিনা-সে বিষয়ে আমার যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।
এই অদ্ভুত জাদুটি কিভাবে প্রদর্শন করা সম্ভব, এ নিয়ে নানাজনের নানান মত। কারো ধারণা-ব্যাপারটা আর কিছুই নয় গণসম্মোহন, ইংরেজিতে যাকে আমরা “মাস্ হিপ্নোটিজম” বলি।

মিলনায়তনের সবাইকে এই সম্মোহন অর্থাৎ হিপ্নোটিজমের মাধ্যমে এমনভাবে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা হয় যে সবাই হাতঘড়ির ছোট কাঁটাটিকে ভুল করে আটটার জায়গায় সাতটায় দেখেন অথবা মোটেও দেরী না হলেও ভুল করে ভাবেন যে অনেকটা দেরী হয়ে গেছে।

ব্যাপারটার আরো এরকম ব্যাখ্যা শুনেছিলাম আমার এক বন্ধুর বাবার কাছ থেকে। তিনি বলেছিলেন, “এটি আসলে খুউব শক্তিশালী একটি চুম্বকের কারসাজি। ঐ জোরালো এক চুম্বকের হুকুমের বান্দা মিলনায়তনের ভেতরকার সবগুলো ঘড়ির কাঁটা। চুম্বকটি যেভাবে ঘুরবে কিংবা ঘোরানো হবে, মিলনায়তনের ভেতরকার সবগুলো ঘড়ির কাঁটা ঠিক সেভাবেই ঘুরতে থাকবে। একচুলও এদিক-ওদিক হবে না। স্কুলের শরীর চর্চার শিক্ষক মাঠভর্তি ডজন ডজন ছাত্রকে একসঙ্গে যেভাবে ড্রিল করান, ব্যাপারটি ঠিক তেমনি। শক্তিশালী ঐ চুম্বকটিকেই কায়দা-মাফিক ঘুরিয়ে দিয়ে মিলনায়তনের ভেতরকার সবগুলো ঘড়িতে সাতটা বাজিয়ে দেয়াটা জাদুকরের কাছে অনেকটা ছেলের হাতের মোয়ার মতোই।

ব্যাপারটির আরো একটু খোলাসা ব্যাখ্যা চাইলে তিনি বেশ স্পষ্টই জবাব দেন-রহস্যটা হল গিয়ে চুম্বক, এই ধারণাটুকুই আপনাকে বলে দিলাম। কোন সাইজের চুম্বক, কোথায় পাওয়া যাবে, কোথায় রেখে কিভাবে ঘোরাতে হবে, সম্পূর্ণ মিলনায়তন জুড়ে কিভাবে চুম্বকীয় আবেশ প্রবাহিত করতে হবে, অতকিছু জানলে তো আমি নিজেই জাদুকর হয়ে যেতাম।”

জাদু সাহিত্যে এই অদ্ভুদ জাদুটির গল্প প্রায় স্থায়ী সম্পদে অর্থাৎ ক্লাসিক-এ এসে দাঁড়িয়েছে। আর এই ব্যাপারটিকেই একটু ভালোভাবে বিশ্লেষণ করলেই এর নেপথ্য কারণটি দাড়াবে এরকমÑআমরা নিজেরা যেমন বিস্মিত হতে ভালোবাসি, তেমনি সমান ভালোবাসি অন্যকে বিস্মিত করতে। জাদু দেখিয়ে কাউকে সত্যি সত্যিই চমক লাগানো সাধনা সাপেক্ষ, প্রতিভা সাপেক্ষ। ব্যাপারটি “ছু মন্তর ছু” নয়, যতটা না কাউকে জাদুর গল্প শুনিয়ে চমক লাগানো। চমক লাগানোর এই উদ্দাম আগ্রহ থেকেই পরের মুখে শোনা কাহিনীকে নিজের চোখে দেখা সত্যি ঘটনা বলে চালিয়ে দেয়ার দুরন্ত লোভ আমাদের প্রায় প্রত্যেকেই সংবরণ করতে পারি না। আর এই লোভ থেকেই স্বাভাবিকভাবে উঠে আসে অতিরঞ্জনের একটা প্রবৃত্তি।

অনেকে আবার গল্পটা করে থাকেন ঠিক এইভাবে। আমার পরিচিতি এক ভদ্রলোকের জবানীতেই বলিÑ “তা না হলে আর বলছি কি আপনাকে? এ আমার পরের মুখে ঝাল খাওয়া নয়, নিজের চোখে দেখা।”

আমি যতই ভদ্রলোকের এই কাহিনীটিকে অলীক, অবাস্তব আর ধোঁয়াশা বলে বাতিল করে দিতে চাইলাম, ভদ্রলোক ততই জোর গলায় বলতে লাগলেন, “সত্যি বলছি, এ আমি নিজের চোখে দেখেছি।”

এ কাহিনী যাদের মুখ থেকে শুনেছিলাম, বর্তমান আলোচনার সুবিধার্থে আমি তাদের একজনের নাম ধরে নিলাম আসাদ। তিনি যথার্থ অর্থেই একজন উদ্যমী-প্রাণচঞ্চল এবং ধীরস্থির দায়িত্বজ্ঞান সম্পন্ন ভদ্রলোক। রীতিমতো বেশ গুরুত্ব সহকারেই গল্পটি তিনি আমাকে শুনিয়েছিলেন, তামাশার ছলে কিংবা ধাপ্পা দিয়ে নয়। এবার গল্পটিকে যদি আমি মিথ্যে বলি, তাহলে নিশ্চিতভাবেই ভদ্রলোককে মিথ্যেবাদী বলতে হবে। কিন্তু আমি হুট করেই বা তা বলি কিভাবে? বরং অন্যভাবে এর ব্যাখ্যা করা যায় কিনা সে প্রসঙ্গে আসি। জাদুকর সরকার তার প্রদর্শনীতে যেসব জাদুগুলো সচরাচর দেখাতেন, তার মধ্যে একটি জাদু ছিল এরকম যে তিনি একজন দর্শককে মঞ্চে ডেকে নিয়ে সেই ব্যাক্তিরই হাতে থাকা ঘড়িটির সময় পাল্টে দিতেন।

জাদুকর সরকারের অদ্ভুদ অথচ চমৎকার এই জাদুটি অনেকেই হয়তো দেখে থাকবেন। তাদের মধ্যে একজন হয়তো কোথাও কথা-প্রসঙ্গে জাদুটির প্রেক্ষাপট বর্ণনা করেছিলেন। জাদুটি তার ভালো লেগেছিল। সুতরাং বর্ণনায় একটু অতিরঞ্জন অর্থাৎ রং চড়ানোটা স্বাভাবিক। তার কাছে যিনি জাদুটির রং চড়ানো বর্ণনা শুনেছিলেন, তিনি অপর একজনকে শোনাবার সময় আরো একটু রং চড়িয়েছিলেন। হয়তো মঞ্চে ডেকে নেয়া একজনটাই এভাবে লোকমুখে ঘুরতে ঘুরতে মিলনায়তন ভর্তি দর্শক হয়ে গেল। এই জাদুটির গল্প হয়তো এভাবে আসাদ সাহেবের কানে গিয়ে উঠেছে। সম্ভবত সরকারের দর্শকরা ধরে নিয়েছিলেন যে, জাদুকর যদি একজনের ঘড়ির সময় পাল্টে দিতে পারেন তো সবারটা পাল্টাতে তার অসুবিধা কোথায় ? সুতরাং সত্যের মুল কাঠামোটিকে ঠিক রেখে বাইরে একটু রং চড়ালে তেমন আর ক্ষতি কি? আসাদ সাহেব হয়তো এও ভেবেছিলেন যে, ব্যাপারটি তিনি ঠিক নিজের চোখে না দেখলেও এমন পরম বিশ্বস্ত সূত্রে শুনেছেন যে, তিনি নিশ্চিত সত্যি হিসেবে ধরে নিতে দ্বিধা করেননি। কারণ এটা অনেকটা নিজের চোখে দেখবার মতই। একটু না হয় ঊনিশ বিশ আর কি ?

ইংরেজিতে একটি প্রবাদ আছে The will to believe ultimately becomes belief itself. অর্থাৎ কোন কিছু বিশ্বাস করবার প্রবল ইচ্ছাটাই শেষ পর্যন্ত প্রকৃত বিশ্বাসে পরিণত হয়। আসাদ সাহেবের ক্ষেত্রে সম্ভবতই তাইই হয়েছিল, যেমনটা অনেকের ক্ষেত্রে হয়ে থাকে।

জাদুকর সরকার সম্পর্কে এ ধরনের আরো অনেক অতিরঞ্জিত কাহিনী প্রচলিত আছে। যার প্রায় সবগুলোই তার জীবিত অবস্থাতেই প্রচলিত ছিল। আসলে তার অসামান্য জনপ্রিয়তাই তাকে এমন জীবন্ত কিংবদন্তীতে পরিণত করেছিল। ইংরেজিতে যাকে বলা চলে “A legend in one’s lifetime”.

জাদুকর সরকারের নিজের আত্মজীবনীমুলক যে বইগুলো প্রকাশিত হয়েছে, সেসবের সব কটিতেই তার বিশ্বজয়ের কাহিনী বেশ ফলাওভাবেই বিবরণসহ লিখেছেন। কিন্তু এ ঘড়ির জাদুটি নিয়ে তেমন কোন উল্লেখ সেই বইগুলোতে নেই। শুধুমাত্র TWSGM THE GREAT SORCAR বইটির একটি অংশে তিনি লিখেছেন“ ঐ ধরনের জাদু আমি নিজে কখনো দেখাইনি এবং মিলনায়তন ভর্তি সব দর্শক নিজ নিজ আসনে বসেই দেখবেন তাদের সবার হাতঘড়ির সময় পাল্টে গেছে, এমন জাদু সত্যি সত্যি কারো পক্ষে দেখানো সম্ভব বলে আমার মনে হয় না।”এমন একটি আশ্চর্য জাদু সত্যিই যদি তিনি দেখিয়ে থাকতেন, তবে সে সম্পর্কে এ ধরনের স্পষ্ট মন্তব্য করবার মতো বিনয়ী জাদুকর সরকার অন্তত ছিলেন না।

এ প্রসঙ্গে আরো একটি তথ্য যোগ করা যায়। জাদুকর সরকারের মধ্যমপুত্র প্রদীপ চন্দ্র সরকার তার আত্মজীবনীমূলক প্রবন্ধ “ওয়াটার অফ ইন্ডিয়া”র একটি পর্বে (সানন্দা, ২৬ নভেম্বর ১৯৯৩) লিখেছেন এরকম “এখনও আমার অনেক দর্শক, যাদের মধ্যে বয়স্কদের সংখ্যায় বেশী, অনুরোধ করেন জাদুটি দেখানোর জন্য। ঘটনা হচ্ছে এই জাদুর ব্যাপারটি পুরোপুরি কল্পনা। বাস্তবে এর কোন ভিত্তি নেই। এরকম জাদু বাবা কোনদিন কোনকালে দেখাননি, দেখাতে পারেননি। কারণ দেখানোটা সম্ভব নয়। বাবার জনপ্রিয়তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এরকম একটা মিথ তৈরি হয়েছিল, বাস্তবে যার কোন অস্তিত্ব ছিল না। বিজ্ঞানকে বাদ দিয়ে জাদু নয়। কিন্তু বিজ্ঞান কি কখনো একঘন্টা পিছিয়ে যেতে পারে? আসলে এ ধরনের জাদু কোনদিনও ছিল না, নেই, হবেও না।
ঘটনাটির এই একটুখানি তফাৎই যে অনেকখানি তফাৎ, অসম্ভব আর সম্ভবের তফাৎ-এটি আমাদের অনেকেরই খেয়াল থাকে না। জাদুকরের জাদু নিয়ে গুজব রটবেই, নানা কিসিমের আষাঢ়ে গল্পও চালু হবে, চালু থাকবে-এটাই স্বাভাবিক।

2 thoughts on “জাদু জগতের আষাঢ়ে গল্প-A real true story in magic.

  1. ধন্যবাদ, আমাকে সন্মানিত করার জন্যে। জাদু চর্চায় সবার সন্মিলিত প্রচেষ্টাই আমাদের এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে অনেকদূর। শুভকামনা উইনম্যাকের জন্যে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

45 − 38 =

%d bloggers like this: